প্রশ্ন : ১৯৫৫ সালের এপ্রিল সংখ্যা তরজমানুল কুরআনে প্রকাশিত মাওলানা আমীন
আহসান ইসলহীর প্রবন্ধের একটি অংশ মে ১৯৫৫ সংখ্যা মাসিক তুলুয়ে ইসলাম
পত্রিকায় উদ্ধৃত হয়েছে। উদ্ধৃত অংশটি নিম্নে প্রদত্ত হলো : "আল্লাহ ও তাঁর
রসূলের মধ্যে যেমন পার্থক্য ও ভেদাভেদ করা চলেনা, তেমনি কুরআন ও সুন্নাহর
মধ্যেও ভেদাভেদ করার অবকাশ নেই।"
অতপর উক্ত বক্তব্য সম্পর্কে মাওলানা ইসলাহী সাহেবকে সম্বোধন করে 'তুলুয়ে ইসলাম' লিখেছেন : "এক রসূলের সাথে অন্যান্য রসূলের ভেদাভেদ করা যাবে না- এ কথা তো কুরআনে আছে। কিন্তু এ কথা কোথাও বলা হয়নি যে, আল্লাহ তাঁর রসূলের মধ্যে পার্থক্য করা চলবেনা। ....দাস ও মনিবের মধ্যে পার্থক্য না করা সুস্পষ্ট শিরক। আপনার এ বক্তব্যের পেছনে কোনো প্রমাণ থেকে থাকলে জানাবেন কি?"
এ কথা ঠিক যে, মাওলানার উক্তির পূর্বাপর বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে বৈষম্য না করার এই নির্দেশ কেবল হুকুমদাতা ও আইন প্রণেতা হিসেবে উভয়ের অস্তিত্ব মর্যাদার ভিত্তিতেই দেয়া হয়েছে। তথাপি তরজমানুল কুরআনের বিষয়টি আরেকটু বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়।
জবাব :
অতপর উক্ত বক্তব্য সম্পর্কে মাওলানা ইসলাহী সাহেবকে সম্বোধন করে 'তুলুয়ে ইসলাম' লিখেছেন : "এক রসূলের সাথে অন্যান্য রসূলের ভেদাভেদ করা যাবে না- এ কথা তো কুরআনে আছে। কিন্তু এ কথা কোথাও বলা হয়নি যে, আল্লাহ তাঁর রসূলের মধ্যে পার্থক্য করা চলবেনা। ....দাস ও মনিবের মধ্যে পার্থক্য না করা সুস্পষ্ট শিরক। আপনার এ বক্তব্যের পেছনে কোনো প্রমাণ থেকে থাকলে জানাবেন কি?"
এ কথা ঠিক যে, মাওলানার উক্তির পূর্বাপর বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে বৈষম্য না করার এই নির্দেশ কেবল হুকুমদাতা ও আইন প্রণেতা হিসেবে উভয়ের অস্তিত্ব মর্যাদার ভিত্তিতেই দেয়া হয়েছে। তথাপি তরজমানুল কুরআনের বিষয়টি আরেকটু বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়।
জবাব :
সোজা কথায় যে ব্যক্তি বক্রতা খোঁজে এবং বক্রতা খুঁজে বের করার
চেষ্টায় লেগে থাকে, পৃথিবীতে তার রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। স্বয়ং কুরআনে
সাক্ষী রয়েছে যে, বিকৃত স্বভাবের লোকেরা আল্লাহর কিতাবের আয়াতগুলোতেও
বক্রতার সন্ধান করা ও অবান্তর তর্ক জুড়ে দেয়া থেকে কখনো বিরত থাকতে পারেনি।
এ ধরণের লোকেরা কোনো মানুষের কথাবার্তায় সামান্যতম ভাষাগত জটিলতা থাকলে তা
থেকে কুফরি এবং শিরক উদঘাটন করবে, তাতে আর অসুবিধা কোথায়? যা হোক, এসব
লোকের জবাব দেয়ার জন্য নয়, বরং আপনার পরিতৃপ্তির জন্য একটু অতিরিক্ত
ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
'আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে প্রভেদ করা।' এক রসূলের সাথে আর এক রসূলের প্রভেদ করা কুরআনের একটা বিশেষ পরিভাষা। কুরআন নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ ভীতি সহকারে ও বুঝে শুনে সমগ্র কুরআন জীবনে একবারও পড়ে, তবে সে এই পরিভাষার সঠিক ও কুরআন সমর্থিত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম না করে পারেনা। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে পার্থক্য বা বৈষম্য করার অর্থ হলো, আল্লাহর উপর ঈমান আনা, তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁর হুকুমকে ইসলামের উৎস ও অকাট্য দলীল হিসেবে স্বীকার করার দাবি করা হবে। কিন্তু রসূলের উপর ঈমান আনা হবেনা। তাঁর আনুগত্য ও অনুকরণ অনুসরণের অঙ্গীকার করা হবেনা, এবং তাঁর নির্দেশকে ইসলামের উৎস ও অকাট্য মৌল দলীল হিসেবেও মানা হবেনা। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা বলতে উভয়ের সত্তায় যে বিভিন্নতা রয়েছে তা বুঝানো হয়নি। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে প্রভেদ করা যাবেনা বলে কুরআনে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার তাৎপর্য এই যে, উভয়ের উপর ঈমান আনতে হবে, উভয়ের আনুগত্য করতে হবে এবং উভয়ের নির্দেশাবলীকে ইসলামের উৎস ও চূড়ান্ত দলীল বলে মানতে হবে। ঐ নির্দেশ দ্বারা একথা বুঝানো হয়নি যে, উভয়ের সত্তাকে অভিন্ন সত্তা মনে করতে হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যে প্রভেদ করা চলবেনা। বস্তুত: এই প্রভেদ করা বা না করা আল্লাহ ও রসূলের সত্তার স্বাতন্ত্র্যের দিক দিয়ে নয়, বরং উভয়ের উপর ঈমান আনা ও উভয়ের আনুগত্যের দিক দিয়ে।
অনুরূপভাবে রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ করার অর্থ হলো নবী ও রসূলগণের মধ্যে কোনো একজন বা কয়েকজনের উপর ঈমান আনার দাবি করা এবং অন্য কোনো রসূল বা রসূলদের উপর ঈমান না আনা। রসূলদের মধ্যে যে ভেদাভেদ ও বৈষম্য করার সমালোচনা করা হয়েছে, তাঁদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার তারতম্যকে স্বীকার করা তার আওতায় আসেনা। এধরনের পার্থক্যকে কে অস্বীকার করতে পারে? আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন যে, আমি তাঁদের কাউকে অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। এই শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাগত তারতম্যটাও মূল রিসালাতের পদের দিক দিয়ে নয়, বরং ব্যক্তিগত গুণ বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে নির্ণিত হয়েছে। বস্তুত: এ বিষয়টার ব্যাখ্যা সাথে সাথেই দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ ও বৈষম্য না করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে তার অর্থ এই যে, সকল নবী ও রসূলের উপর ঈমান আনতে হবে। তবে এর দ্বারা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করতে হবে এটা কখনো বুঝানো হয়নি।
কুরআন আল্লাহ ও রসূলের মধ্যে ভেদাভেদ এবং রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ না করাকে ঈমানের আলামত ও ভেদাভেদ করাকে কুফরির আলামত বলা হয়েছে। আপনি মাসিক তুলুয়ে ইসলামের এ কথাটিকে এক পাশে রাখুন যে, "কুরআনে এক রসূলের সাথে অন্য রসূলের পার্থক্য করতে তো নিষেধ করা হয়েছে কিন্তু আল্লাহ ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য করতে নিষেধ করা হয়নি।" অত:পর নিম্নের আয়াত কয়টি পড়ুন :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"নিশ্চয় যারা আল্লাহ তাঁর রসূলদের প্রতি কুফরিতে লিপ্ত হয়, আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ করতে চায়, কাউকে মানি ও কাউকে মানিনা বলে ঘোষণা করে এবং একটা মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করতে চায়, তারাই আসল কাফির। আমি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছি। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে এঁদের কারো মধ্যে ভেদাভেদ করেনি। তাদেরকে আল্লাহ অচিরেই পুরস্কৃত করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।" (সূরা আন নিস, আয়াত : ১৫০-১৫২)
এবার আয়াত ক'টিতে যে বক্তব্য বিধৃত হয়েছে, তা কি মাওলানা ইসলাহীর উদ্ধৃত বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে সমর্থন করছে না এবং তুলুয়ে ইসলামের উল্লিখিত আপত্তিতে সর্বোতভাবে খণ্ডন করছে না? তুলুয়ে ইসলামের আশ্রয়পুষ্ট হাদিস বিরোধী মহলটির হাদিসের উপর হস্তক্ষেপ করতে করতে এতোই কি ঔদ্ধত্য বেড়ে গেছে এবং এতোটাই কি হাত পেকে গেছে যে, এখন তারা কুরআনের উপরও হাত সাফাই করা শুরু করে দিয়েছে। কুরআনের এ আয়াতগুলোর আয়নায় তুলুয়ে ইসলামের নিজের চেহারা বা তদ্সদ্শ চেহারা ভেসে ওঠে বলেই কি তারা এ আয়াতগুলোকে উপেক্ষা করতে উদ্যত। (তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৫৫)
No comments:
Post a Comment